কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি: দীর্ঘ ৫২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্বীকৃতি পেলেন শামসুদ্দীন আহমেদ। ১৯৭১ সালে রাজশাহী সদরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। সেখানে তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁর মরদেহটিও পায়নি স্বজনরা। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর নাম (গেজেট-৪২৭ এর তৃতীয় তালিকায় তাঁর ক্রমিক নম্বর ৯২)।
শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুদ্দীন আহমেদের বড় ছেলে সালাহউদ্দিন আহমেদ সেলু বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, দীর্ঘদিন পর হলেও এ খবরে স্বস্তি ফিরেছে আমাদের পরিবারে। বাবার বুদ্ধিজীবী স্বীকৃতির জন্য আমার মা সারাজীবন চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র যখন বাবাকে স্বীকৃতি দিল তখন মা বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর মতো খুশি কেউ হতো না। আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলা সদরের সাচাইল গ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের ছেলে শামসুদ্দীন আহমেদ। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি তাড়াইল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সুপিরিয়র্স সার্ভিসে কুমিল্লার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারি চাকরি যোগ দেন। এরপর ঢাকায় বদলি হন। মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে তাঁকে রাজশাহী জেলায় বদলি করা হয়। কর্মক্ষেত্রে তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে জড়িয়ে পড়েন। তরুণদেরও নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল সরকারি জিপে চড়ে তানোর থানায় যাচ্ছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল সংগ্রাম কমিটির সভা যোগদান করা। পথে পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে আটক ও হত্যা করে। কিন্তু তাঁর লাশটি ফেরত দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনী এতটা ক্ষিপ্ত ছিল যে রাজশাহীতে তাঁর বাসাটি পর্যন্ত পুড়িয়ে দেয়। ওই সময় তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা কিশোরগঞ্জে ছিল বলে প্রাণে বেঁচে যায়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে শামসুদ্দীন আহমেদ শহীদ হয়েছেন বলে পরিবারের লোকজন জানতে পারে। ১৯৭২ সালের ২৭মার্চ প্রকাশিত গেজেটে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর মৃত্যুর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়। এতে পরিবারের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয়।
সালাউদ্দিন আহমেদ সেলু বলেন, সরকারিভাবে শহীদদের তালিকা প্রকাশ করা হলেও এতে বাবার নাম ছিল না। এ কারণে আমরা অর্ধ-শতাব্দীকাল গভীর বেদনা ও দুঃখবোধ নিয়ে বেঁচে ছিলাম। ৫২ বছর বাবার শহীদের স্বীকৃতি আমাদের নতুনভাবে প্রেরণ জোগাবে।
তিনি বলেন, মা সিদ্দিকা বেগম ছিলেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের মেয়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর সহকারী শিক্ষকের চাকরি করেছেন। ছেলেমেয়েদের আগলে রেখেছেন। এর মধ্যেই টানা ছয়টি বছর স্বজনদের নিয়ে স্বামীর লাশের সন্ধান করেছেন। কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি। স্বামীর শহীদের মর্যাদা আদায়ে আজীবন লড়ে গেছেন তিনি। বিভিন্ন দপ্তরে দিনের পর দিন ঘুরেছেন। এই দুঃখবোধ নিয়েই তিনি মারা গেছেন। আজ মা বেঁচে থাকলে তাঁর মতো খুশি কেউ হতো না।